মুহতারাম হাযেরীন!
মুহাররাম হলো ইসলামী বর্ষ গণনার প্রথম মাস। রাসূলুল্লাহ -এর সময়ে ও তার পূর্বে রোমান, পারসিয়ান ও অন্যান্য জাতির মধ্যে তাদের নিজস্ব ক্যালেন্ডার প্রচলিত ছিল। আরবদের মধ্যে কোনো নির্ধারিত বর্ষ গণনা পদ্ধতি ছিল না। বিভিন্ন ঘটনার উপর নির্ভর করে তারিখ বলা হতো। যেমন, অমুক ঘটনার অত বৎসর পরে...।
খলীফা উমার (রা) এর খিলাফতের তৃতীয় বা চতুর্থ বৎসর আবূ মূসা আল আশআরী (রা) তাঁকে পত্র লিখে জানান যে, আপনার সরকারী ফরমানগুলিতে সন-তারিখ না থাকায় প্রশাসনিক জটিলতা দেখা দেয়; এজন্য একটি বর্ষ গণনার তারিখ ব্যবহার করা প্রয়োজন। খলীফা উমার (রা) সাহাবীগণকে একত্রিত করে পরামর্শ চান। কেউ কেউ রোম বা পারস্যের পঞ্জিকা ব্যবহার করতে পরামর্শ দেন। কিন্তু অন্যরা তা অপছন্দ করেন এবং মুসলিমদের জন্য নিজস্ব পঞ্জিকার প্রয়োজনীয়তার কথা বলেন। এ বিষয়ে কেউ কেউ পরামর্শ দেন যে, রাসূলুল্লাহ (সা)-এর জন্ম থেকে সাল গণনা শুরু করা হোক। আবার কেউ কেউ তাঁর নুবুওয়াত থেকে, কেউ কেউ তাঁর হিজরত থেকে এবং কেউ কেউ তাঁর ওফাত থেকে বর্ষ গণনার পরামর্শ দেন।
হযরত আলী (রা) হিজরত থেকে সাল গণনার পক্ষে জোরালো পরামর্শ দেন। খলীফা উমার (রা) এ মত সমর্থন করে বলেন যে, হিজরতই হক্ক ও বাতিলের মধ্যে পার্থক্যের সূচনা করে; এজন্য আমাদের হিজরত থেকেই সাল গণনা শুরু করা উচিত। অবশেষে সাহাবীগণ হিজরত থেকে সাল গণনার বিষয়ে একমত পোষণ করেন। কোন্ মাস থেকে বর্ষ গণনা শুরু করতে হবে সে বিষয়ে পরামর্শ চাওয়া হয়। কেউ কেউ রবিউল আউয়াল মাসকে বৎসরের প্রথম মাস হিসেবে গ্রহণ করার পুরামর্শ দেন; কারণ রাসূলুল্লাহ (সা) এ মাসেই হিজরত করে মদীনায় আগমন করেন। ১২ই রবিউল আউয়াল তিনি মদীনায় পৌঁছান। কেউ কেউ রামাদান থেকে বর্ষ শুরুর পরামর্শ দেন; কারণ রামাদান মাসে আল্লাহ কুরআন নাযিল করেছেন। সর্বশেষ তাঁরা মুহারাম মাস থেকে বর্ষ শুরুর বিষয়ে একমত হন; কারণ এ মাসটি ৪টি 'হারাম' বা সম্মানিত মাসের একটি। এছাড়া ইসলামের সর্বশেষ রুকন হজ্জ পালন করে মুসলিমগণ এ মাসেই দেশে ফিরেন। হজ্জ পালনকে বৎসরের সর্বশেষ গুরুত্বপূর্ণ কর্ম ধরে মুহারাম মাসকে নতুন বৎসরের শুরু বলে গণ্য করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। এভাবে রাসূলুল্লাহ -এর ইন্তেকালের প্রায় ৬ বৎসর পরে ১৬ বা ১৭ হিজরী সাল থেকে সাহাবীগণের ঐকমত্যের ভিত্তিতে হিজরী সালগণনা শুরু হয়। যদিও হিজরত রবিউল আউয়াল মাসে সংঘটিত হয়, তবুও দু'মাস এগিয়ে, সে বৎসরের মুহাররাম থেকে বর্ষ গণনা শুরু হয়।'
সম্মানিত মুসল্লীবৃন্দ,
বৎসরের চারটি ‘হারাম’ মাস: যিলকাদ, যুলহাজ্জ, মুহাররম ও রজব। এ মাসগুলো ইসলামী শরীয়তে বিশেষভাবে সম্মানিত। আল্লাহ বলেছেন:
اِنَّ عِدَّۃَ الشُّهُوۡرِ عِنۡدَ اللّٰهِ اثۡنَا عَشَرَ شَهۡرًا فِیۡ كِتٰبِ اللّٰهِ یَوۡمَ خَلَقَ السَّمٰوٰتِ وَ الۡاَرۡضَ مِنۡهَاۤ اَرۡبَعَۃٌ حُرُمٌ ؕ ذٰلِكَ الدِّیۡنُ الۡقَیِّمُ ۬ۙ فَلَا تَظۡلِمُوۡا فِیۡهِنَّ اَنۡفُسَكُمۡ.
‘‘আকাশমন্ডলী ও পৃথিবীর সৃষ্টির দিন হতেই আল্লাহর বিধানে আল্লাহর নিকট মাস গণনায় মাস বারটি, তন্মধ্যে চারটি নিষিদ্ধ মাস। এটি সুপ্রতিষ্ঠিত বিধান। সুতরাং এ নিষিদ্ধ মাসগুলোর মধ্যে তোমরা নিজেদের প্রতি জুলুম করো না...।’’
এ সকল মাসে সকল প্রকার পাপ ও অন্যায় থেকে বিরত থাকতে ও অধিক নেক আমল করতে কুরআন ও হাদীসে নির্দেশ প্রদান করা হয়েছে।
এ ৪ মাসের মধ্যে মুহারাম মাসকে বিশেষভাবে মর্যাদা প্রদান করে একে 'আল্লাহর মাস' বলে আখ্যায়িত করেছেন।
সহীহ মুসলিমে সংকলিত হাদীসে রাসুলুল্লাহ (ﷺ) বলেন:
أفْضَلُ الصِّيَامِ بَعْدَ رَمَضَانَ شَهْرُ اللهِ المُحَرَّمُ
‘রামাদানের পরে সর্বোত্তম সিয়াম হলো আল্লাহর মাস মুহার্রাম মাস।’
সম্মানিত হাযেরীন!
মুহারাম মাসের ১০ তারিখকে 'আশূরা' বলা হয়। বিশেষভাবে এ দিনটির সিয়াম পালনের নির্দেশনা দিয়েছেন রাসূলুল্লাহ (সা)। জাহিলী যুগে মক্কার মানুষেরা আশূরার দিন সিয়াম পালন করত এবং কাবা ঘরের গেলাফ পরিবর্তন করত। হিজরতের পূর্বে মক্কায় অবস্থান কালে রাসূলুল্লাহ নিজেও এ দিন সিয়াম পালন করতেন। মদীনায় হিজরতের পরে তিনি এ দিনে সিয়াম পালনের জন্য মুসলিমদেরকে নির্দেশ দেন। এ বিষয়ে ইবনু আব্বাস (রা) বলেন:
إِنْ رَسُولَ اللَّهِ ﷺ قَدِمَ الْمَدِينَةَ فَوَجَدَ الْيَهُودَ صِيَامًا يَوْمَ عَاشُورَاءَ فَقَالَ لَهُمْ رَسُولُ اللَّهِ ﷺ مَا هَذَا الْيَوْمُ الَّذِي تَصُومُونَهُ فَقَالُوا هَذَا يَوْمٌ عَظِيمٌ أَنْجَى اللَّهُ فِيهِ مُوسَى وَقَوْمَهُ وَغَرَّقَ فِرْعَوْنَ وَقَوْمَهُ فَصَامَهُ مُوسَى شُكْرًا
فَنَحْنُ نَصُومُهُ فَقَالَ رَسُولُ اللهِ ﷺ فَنَحْنُ لَحَقِّ وَأُولَى بِمُوسَى مِنْكُمْ فَصَامَهُ رَسُولُ اللَّهِ ﷺ وَأَمَرَ بِصِيَامه
রাসূলুল্লাহ ﷺ মদীনায় এসে দেখলেন যে, ইহুদীরা আশুরার দিনে রোজা পালন করছে। তিনি তাদের জিজ্ঞেস করলেন, এটা কোন্ দিন যে তোমরা রোজা পালন করছ? তারা বলল, এটা এমন এক মহান দিবস যেদিন আল্লাহ মুছা (আ.) ও তার সম্প্রদায়কে নাজাত দিয়েছিলেন মুছা আ. শুকরিয়া হিসেবে এ দিনে রোজা পালন করেছেন। এ কারণে আমরাও রোজা পালন করে থাকি। এ কথা শুনে রাসূলুল্লাহ ﷺ বললেন, “তোমাদের চেয়ে আমরা মুছা আ. এর অধিকতর ঘনিষ্ট ও নিকটবর্তী।” অতঃপর রাসূলুল্লাহ ﷺ রোজা পালন করলেন ও অন্যদেরকে রোজা পালনের নির্দেশ দিলেন
আব্দুল্লাহ বিন আব্বাস (রাযি.) বর্ণনা করেন,
حِينَ صَامَ رَسُولُ اللَّهِ ﷺ يَوْمَ عَاشُورَاءَ وَأَمَرَ بِصِيَامِهِ قَالُوا يَا رَسُولَ اللَّهِ، إِنَّهُ يَوْمٌ تُعَظِّمُهُ الْيَهُودُ وَالنَّصَارَى، فَقَالَ رَسُولُ اللَّهِ ﷺ “فَإِذَا كَانَ الْعَامُ الْمُقْبِلُ إِنْ شَاءَ اللَّهُ صُمْنَا الْيَوْمَ التَّاسِعَ”. قَالَ فَلَمْ يَأْتِ الْعَامُ الْمُقْبِلُ حَتَّى تُوُفِّيَ رَسُولُ اللَّهِ ﷺ
যখন রাসূলুল্লাহ ﷺ আশুরার রোজা রাখলেন এবং (অন্যদেরকে) রোজা রাখার নির্দেশ দিলেন। লোকেরা বলল, হে আল্লাহর রাসূল! এটিতো এমন দিন, যাকে ইহুদি ও খ্রিষ্টানরা বড় জ্ঞান করে, সম্মান জানায়। তখন রাসূলুল্লাহ ﷺ বললেন, আগামী বছর এদিন আসলে, আমরা নবম দিনও রোজা রাখব ইনশাল্লাহ। বর্ণনাকারী বলছেন, আগামী বছর আসার পূর্বেই রাসূলুল্লাহ ﷺ-এর ওফাত হয়ে গিয়েছে। ( মুসলিম হা/১৯৪৬)
এ মাসের ১০ তারিখ ‘আশূরা’র দিনে সিয়াম পালনের বিশেষ ফযীলত রয়েছে। আশূরার সিয়াম সম্পর্কে রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেন:
صِيَامُ يَوْمِ عَاشُورَاءَ أَحْتَسِبُ عَلَى اللَّهِ أَنْ يُكَفِّرَ السَّنَةَ الَّتِي قَبْلَهُ
আশুরার সাওম সম্পর্কে আমি আল্লাহর কাছে আশাবাদী যে, তাতে পূর্ববর্তী বছরের গুনাহসমূহের কাফফারা হয়ে যাবে।
( মুসলিম হা/১৯৭৬)
0 মন্তব্যসমূহ